আয়কর (Income Tax) হলো রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয় উৎস, যার মাধ্যমে সরকার দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশে আয়কর দাখিল এবং TIN গ্রহণ বাধ্যতামূলক অনেক ক্ষেত্রেই। এ আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো কিভাবে আয়কর দাখিল করবেন, কারা বাধ্যতামূলক আয়কর দিবেন, অনলাইন রিটার্ন দাখিল, ফ্রিল্যান্সার ও প্রবাসীদের জন্য আয়করের নিয়মাবলীসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
১. আয়কর কী?
আয়কর হচ্ছে ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময়ের (সাধারণত এক অর্থবছর) আয়ের উপর সরকার কর্তৃক ধার্যকৃত একটি কর। এটি প্রত্যক্ষ করের একটি রূপ, যা ব্যক্তিগত আয়, ব্যবসায়িক লাভ, পেশাগত ফি, সুদ, ভাড়া, অনলাইন আয় ইত্যাদির উপর আরোপিত হয়।
২. কারা আয়কর দেবেন?
- যাদের বার্ষিক আয় নির্ধারিত ট্যাক্সযোগ্য সীমার উপরে
- যারা কোম্পানি বা ব্যবসা পরিচালনা করেন
- ফ্রিল্যান্সার বা অনলাইন ইনকামের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা
- সরকারি/বেসরকারি চাকরিজীবী (আয় নির্দিষ্ট সীমার উপরে হলে)
- প্রবাসীরা যাদের বাংলাদেশে আয় হয়
৩. TIN (Tax Identification Number) কী এবং কেন প্রয়োজন?
TIN হলো একটি ইউনিক নম্বর যেটি আয়কর রিটার্ন দাখিল, ব্যাংক হিসাব খোলা, জমি ক্রয়-বিক্রয়, গাড়ি রেজিস্ট্রেশনসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) থেকে অনলাইনে সহজেই গ্রহণ করা যায়।
TIN সংগ্রহের ধাপ:
- https://etaxnbr.gov.bd ওয়েবসাইটে যান
- “e-Registration” এ ক্লিক করে ফর্ম পূরণ করুন
- NID, মোবাইল নম্বর, ইমেইল দিয়ে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করুন
- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে OTP ও প্রোফাইল ভেরিফাই করুন
- সফলভাবে TIN সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন
৪. আয়কর রিটার্ন কী?
আয়কর রিটার্ন হলো এক ধরনের বিবরণী, যেখানে আপনি এক অর্থবছরের সব আয়ের উৎস, খরচ, কর ও কর মওকুফের তথ্য NBR-কে জানান। এটি প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হয় (সাধারণত ৩০ নভেম্বর)।
রিটার্ন জমা না দিলে কী হয়?
- জরিমানা এবং অতিরিক্ত কর
- অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবা (জমি রেজিস্ট্রি, পাসপোর্ট রিনিউ) আটকে যেতে পারে
- আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে
৫. অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল
বর্তমানে ঘরে বসেই eReturn পদ্ধতিতে অনলাইনেই রিটার্ন দাখিল করা যায়। এটি করতে হলে আপনাকে etaxnbr.gov.bd তে লগইন করে “e-return” মেনুতে যেতে হবে।
পাঠ্য ডকুমেন্টস:
- TIN সার্টিফিকেট
- NID
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট
- জমি, গাড়ির দলিল (যদি থাকে)
- বেতন/অন্যান্য আয়ের স্লিপ
৬. ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আয়কর
বর্তমানে ফ্রিল্যান্সারদের আয় আন্তর্জাতিকভাবে বৈধভাবে আসে এবং এটি সরকারের দৃষ্টিতে আয়করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত।
কেন ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স দিতে হবে?
- আয় যদি ট্যাক্সযোগ্য সীমার উপরে হয়
- ব্যাংকে বা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে ডলার/বিদেশি মুদ্রার মাধ্যমে আয় আসে
কর হার:
২০২৪-২৫ অর্থবছর অনুযায়ী, ৩,৫০,০০০ টাকার বেশি আয় হলে করযোগ্য ধরা হয়। এরপর বিভিন্ন স্ল্যাব অনুযায়ী কর নির্ধারিত হয়।
টিপস:
- আয়ের উৎস দেখিয়ে ব্যাংকে ট্রানজেকশন করুন
- বাণিজ্যিকভাবে রেজিস্ট্রেশন করা থাকলে কর হ্রাস সুবিধা মিলতে পারে
৭. প্রবাসীদের আয়কর
যেসব প্রবাসী বাংলাদেশে আয় করছেন (জমি, বাড়ি ভাড়া, ব্যবসা, ইত্যাদি) তাদের আয়কর দাখিল বাধ্যতামূলক। তবে বিদেশে অর্জিত আয়ের উপর সাধারণত কর প্রযোজ্য নয়, যদি না সেই অর্থ দেশে বিনিয়োগ করে আয় করছেন।
কি ধরনের আয় প্রবাসীদের করযোগ্য?
- বাংলাদেশে সম্পত্তি থেকে আয়
- ব্যাংক ডিপোজিটে ইন্টারেস্ট
- শেয়ার/বিনিয়োগ থেকে আয়
৮. আয়কর ছাড় ও রিবেট সুবিধা
সরকার কিছু খাতে কর ছাড় বা রিবেট সুবিধা দেয়, যেমন:
- বীমা প্রিমিয়াম
- সঞ্চয়পত্র
- চ্যারিটি ও দান
- শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়
৯. ট্যাক্স ফাইলিং এর পরবর্তী সুবিধা
- ভিসা প্রসেস সহজ হয়
- ব্যাংক ঋণ পাওয়া সহজ হয়
- ট্রাস্টেবল নাগরিক হিসেবে পরিচিতি
- সরকারি টেন্ডার বা বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে সুবিধা
১০. উপসংহার
আয়কর শুধু রাষ্ট্রের জন্য নয়, ব্যক্তির জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও সম্মানজনক নাগরিক কর্তব্য। সঠিকভাবে TIN গ্রহণ ও রিটার্ন দাখিল করলে একদিকে যেমন আপনি আইনি সুরক্ষা পান, অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখেন। তাই আজ থেকেই আপনার আয়কর সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুন এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলুন।