আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সরকার জনগণের বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে রাজস্ব সংগ্রহ করে, যার অন্যতম প্রধান উৎস আয়কর। বাংলাদেশে আয়কর শুধু রাজস্ব নয়, নাগরিক দায়িত্ব ও সচেতনতার প্রতিফলনও। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো আয়কর সম্পর্কে—এর ধরন, কাকে দিতে হয়, কিভাবে রিটার্ন দাখিল করবেন, ছাড় সুবিধা, এবং সাধারণ ভুলগুলো কীভাবে এড়াবেন।
আয়কর কী?
আয়কর হলো ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে নির্দিষ্ট হারে সরকারকে দেওয়া কর। এটি প্রত্যক্ষ করের মধ্যে পড়ে এবং এটি দেশের জাতীয় আয়ের একটি বড় উৎস। বাংলাদেশে আয়কর আইন ১৯৮৪ অনুযায়ী আয়কর সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
কারা আয়কর দেবে?
যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি নির্দিষ্ট সীমার বেশি আয় করে, তবে তাকে আয়কর দিতে হবে। নিচে কিছু মূল ক্যাটাগরি দেওয়া হলো:
- যেসব ব্যক্তির বার্ষিক আয় নির্ধারিত করমুক্ত সীমার বেশি
- প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি ইত্যাদি
- যারা সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে নিযুক্ত এবং বেতন থেকে ট্যাক্স কাটা হয়
বর্তমান করমুক্ত আয়সীমা (২০২৪-২৫ অর্থবছর অনুযায়ী)
- পুরুষ ও নারীদের জন্য: ৩,৫০,০০০ টাকা
- প্রবীণ নাগরিক (৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে): ৪,৫০,০০০ টাকা
- মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য: ৫,০০,০০০ টাকা
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য: ৪,৭৫,০০০ টাকা
আয়করের ধরন
- বেতনভিত্তিক আয়: চাকরিজীবীদের বেতন, বোনাস, সুবিধাদি।
- ব্যবসায়িক আয়: দোকান, ফার্ম, কোম্পানি, বা ফ্রিল্যান্সিং আয়ের ওপর।
- সম্পত্তি ভাড়া আয়: বাড়ি, দোকান, জমি ইত্যাদি ভাড়া থেকে আয়।
- আগ্রহ ও লভ্যাংশ: ব্যাংক ডিপোজিটের ইন্টারেস্ট, ডিভিডেন্ড।
- অন্যান্য উৎস: উপহার, লাভজনক খাত, ইত্যাদি।
আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম
প্রত্যেক করদাতা ব্যক্তিকে প্রতি অর্থবছর শেষে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দাখিল করতে হয়।
১. টিআইএন (TIN) নম্বর সংগ্রহ
প্রথম ধাপ হচ্ছে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) সংগ্রহ করা। আপনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) এর ওয়েবসাইট থেকে এটি বিনামূল্যে নিতে পারেন।
২. আয় ও ব্যয়ের বিবরণ প্রস্তুত করা
আপনার বছরে আয়ের উৎস, ব্যয়, বিনিয়োগ ইত্যাদির বিবরণ সংরক্ষণ করুন।
৩. রিটার্ন ফর্ম পূরণ
আপনি অনলাইনে বা হাতে পূরণ করতে পারেন। অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া বর্তমানে অনেক সহজ এবং জনপ্রিয়।
৪. রিটার্ন দাখিল
আয়কর রিটার্ন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাখিল করুন (সাধারণত ৩০ নভেম্বর)। দেরিতে জমা দিলে জরিমানা দিতে হতে পারে।
কর ছাড় ও বিনিয়োগ সুবিধা
বাংলাদেশ সরকার করদাতাদের বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে, যেমন:
- জীবন বীমা প্রিমিয়াম
- শিক্ষা সঞ্চয় স্কিম
- সরকারি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ
- অবসরকালীন সঞ্চয় (Pension Scheme)
নিয়মিত রিটার্ন দাখিলের উপকারিতা
- ব্যাংক ঋণ গ্রহণ সহজ হয়
- ভিসা আবেদন সহজ হয়
- বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারী ছাড় পাওয়া যায়
- আইনি নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়
সচরাচর ভুলসমূহ
- রিটার্ন দাখিল না করা
- ভুল তথ্য প্রদান
- ছাড় গ্রহণে প্রমাণ না দেওয়া
- দেরিতে রিটার্ন দাখিল
সচেতনতা বৃদ্ধিতে করজ্ঞান
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয়কর সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা, টিভি ও অনলাইন প্রচারণা, কর্মশালা ইত্যাদির মাধ্যমে কর সংস্কৃতির উন্নয়ন করা দরকার।
অনলাইন সেবা ও আধুনিকায়ন
বর্তমানে অনলাইনে কর পরিশোধ, রিটার্ন দাখিল, এবং সনদ প্রাপ্তি প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। এর ফলে দুর্নীতি কমেছে এবং সময় বাঁচে।
উপসংহার
আয়কর প্রদান কেবল সরকারের আয় বাড়ানোর জন্য নয়, বরং এটি নাগরিক দায়িত্ব পালনের একটি প্রতীক। আয়কর দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুললে দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।