সংবিধান সংস্কারে রাজনৈতিক দলের অবস্থান: একটি বিশ্লেষণ
তারিখ: ২৭ মে ২০২৫ | তথ্যসূত্র: দৈনিক সমকাল
বাংলাদেশের সংবিধান দেশের শাসনব্যবস্থা ও জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের মূল ভিত্তি। সময়ের পরিবর্তনে এই সংবিধান সংস্কার প্রয়োজন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশন থেকে প্রস্তাবিত একটি সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত তালিকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ শাসন কাঠামো নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
প্রস্তাবিত ১২ দফা সংস্কার এবং রাজনৈতিক দলের অবস্থান
নিচে কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার ও চারটি প্রধান রাজনৈতিক দল—বিএনপি, জামায়াত, এবং এনডিপির—অবস্থান বিশ্লেষণ করা হলো।
১. প্রধানমন্ত্রী মাত্র দুইবার হতে পারবেন
এই প্রস্তাবের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, টানা হোক বা বিচ্ছিন্ন। এনডিপি ও জামায়াত এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও বিএনপি বিরোধিতা করেছে। এটি ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তা।
২. প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রধান হওয়া যাবে না
এই প্রস্তাবের মাধ্যমে দল ও সরকার আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এনডিপি একে সমর্থন করে, জামায়াত নীরব থেকেছে এবং বিএনপি সরাসরি বিরোধিতা করেছে।
৩. প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা হতে পারবেন না
একইভাবে প্রধানমন্ত্রী যদি সংসদের নেতা না হন, তাহলে সংসদ কার্যক্রম আরও স্বতন্ত্র হবে। এনডিপি একে সমর্থন করেছে।
৪. সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ
দ্বিতীয় একটি পার্লামেন্টারি চেম্বার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের আদলে হতে পারে। বিএনপি ও জামায়াত বিরোধিতা করলেও এনডিপি একে সমর্থন জানিয়েছে।
৫. জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)
একটি স্বাধীন সংস্থা যেটি বিচারপতি ও অন্যান্য সংবিধানিক নিয়োগ সুপারিশ করবে। এনডিপি একে সমর্থন দিয়েছে, অন্য দলগুলোর অবস্থান অস্পষ্ট।
৬. এনসিসির মাধ্যমে সাংবিধানিক নিয়োগ
এই প্রস্তাব বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। এনডিপি সমর্থন করলেও বিএনপি ও জামায়াত বিরোধিতা করেছে।
৭. নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন
বর্তমানে কোটা ভিত্তিক মনোনয়নে নারী সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো যেতে পারে। এনডিপি এই প্রস্তাব সমর্থন করলেও বিএনপি ও জামায়াত বিরোধিতা করেছে।
৮. সংবিধান সংশোধনে গণভোট
গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নেওয়ার প্রস্তাব অত্যন্ত গণতান্ত্রিক। তিনটি দলই একে সমর্থন করেছে।
৯. জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি প্রধান বিচারপতি
এই প্রস্তাব বিচার বিভাগের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি ও এনডিপি সমর্থন দিলেও জামায়াত বিরোধিতা করেছে।
১০. রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে বহুদলবাদ
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে বহুদলবাদের অন্তর্ভুক্তি নতুন মাত্রা আনবে। বিএনপি বিরোধিতা করলেও অন্যান্য দল সমর্থন করেছে।
১১. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস
প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর একক আধিপত্য কমাতে চায়। বিএনপি এর বিকল্প হিসেবে "আর্ন্তরিক রাজি", জামায়াত সমর্থন দেয়নি, এনডিপি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।
১২. নির্বাচনী পদ্ধতি ও বাস্তবায়ন
নির্বাচনের পদ্ধতিগত সংস্কার জরুরি। বিএনপি বর্তমান পদ্ধতি চায়, জামায়াত পরিবর্তন চায় এবং এনডিপি বর্তমান পদ্ধতি সমর্থন করে। বাস্তবায়ন কিভাবে হবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে—বিএনপি সংসদের মাধ্যমে, জামায়াত গণভোট চায় এবং এনডিপি চায় গণপরিষদের মাধ্যমে।
বিশ্লেষণ: কারা কতটা সংস্কারপন্থী?
এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, এনডিপি সবচেয়ে বেশি সংস্কারপন্থী। তারা প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে। জামায়াত কিছু কিছু সংস্কারে সম্মতি দিয়েছে, কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছে। বিএনপি বেশিরভাগ প্রস্তাবেই সরাসরি বিরোধিতা করেছে বা অস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে।
জনগণের প্রত্যাশা ও প্রয়োজন
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান সংস্কার শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব নয়; জনগণের মতামত, দাবি এবং অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। গণভোট চালুর প্রস্তাবটি জনগণকে কেন্দ্র করে গঠিত রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ইঙ্গিত। প্রধানমন্ত্রী পদের সীমাবদ্ধতা, বিচারপতি নিয়োগ, এবং নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ—এই সবকিছুই দেশের রাজনীতিকে আরও গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ করতে পারে।
উপসংহার
সংবিধান একটি জীবন্ত দলিল, যা সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার এবং রাজনৈতিক দলের অবস্থান জনগণের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল। দৈনিক সমকালের এই বিশ্লেষণ সেই অভাব পূরণ করেছে। এখন সময় এসেছে রাজনৈতিক দলগুলো যেন নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করে দেশের স্বার্থে কার্যকর ও টেকসই সংস্কারকে সমর্থন দেয়।
তথ্যসূত্র: দৈনিক সমকাল | ২৭ মে ২০২৫